মাওলানা হাকীম মুহাম্মদ আখতার ছাহেব (রহ.)
জীবনী, চিন্তা ও অবদান
মাওলানা হাকীম মুহাম্মদ আখতার ছাহেব (রহ.) ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম বিশিষ্ট সুফি, আলেম এবং আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক। তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি ইলম, আমল ও তাসাউফের সমন্বিত এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর জীবন ছিল আল্লাহর প্রতি গভীর প্রেম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণ, এবং মানুষের অন্তরের সংস্কার (ইস্লাহে বাতিন) সাধনার এক আলোকিত অধ্যায়।
জন্ম ও শৈশব
মাওলানা হাকীম মুহাম্মদ আখতার (রহ.) ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের উত্তরপ্রদেশের হরদোই জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, বিনয়ী ও নরম স্বভাবের। প্রাথমিক শিক্ষাজীবন থেকেই তাঁর মধ্যে কুরআন-সুন্নাহর প্রতি গভীর ভালোবাসা লক্ষ্য করা যেত।
শিক্ষা ও ইলমী যাত্রা
শিক্ষাজীবনের শুরুতেই তিনি কুরআন মাজিদ মুখস্থ করেন এবং দারস-এ-নিজামী কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা করে হাকীমি ডিগ্রি অর্জন করেন। এ কারণেই তাঁর নামের আগে "হাকীম" শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তবে তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইলমে দীনের প্রচার ও মানুষের অন্তরের ইস্লাহ।
মাওলানা হাকীম সাহেব (রহ.) হাদিস, ফিকহ, তাফসিরে পারদর্শী ছিলেন এবং তিনি আলেমদের সান্নিধ্যে নিজেকে তৈরি করেন। তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হন হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর খলিফাগণ ও তাদের আধ্যাত্মিক ধারা দ্বারা।
তাসাউফে দীক্ষা ও আধ্যাত্মিকতা
তিনি তাসাউফে দীক্ষা গ্রহণ করেন শায়খুল হাদিস মাওলানা আবদুল গফুর সাহেব (রহ.)-এর হাত ধরে এবং পরে মাওলানা শাহ আব্দুল গফুর সাহেব (রহ.) ও অন্যান্য আকাবিরদের খিদমতে থেকে সুলুক ও তাসাউফের পথ সম্পন্ন করেন। পরিশেষে তিনি খিলাফত প্রাপ্ত হন এবং নিজের খানকা (আধ্যাত্মিক কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে বিশ্বজুড়ে মুরিদদের আধ্যাত্মিক আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে।
খানকা-এ-আখতরিয়া
মাওলানা সাহেব (রহ.) করাচিতে খানকা-এ-আখতরিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল একটি প্রাণবন্ত তাজকিয়া ও তাসাউফের কেন্দ্র যেখানে মানুষ শুধু নামাজ, জিকির, এবং দোয়া শিখতো না; বরং চরিত্র সংশোধন, গুনাহ থেকে বাঁচা এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করার শিক্ষা পেতো। এই খানকা শুধু পাকিস্তানেই নয়, ভারত, বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আধ্যাত্মিক শাখা গড়ে তোলে।
প্রধান গ্রন্থ ও সাহিত্য
মাওলানা হাকীম মুহাম্মদ আখতার (রহ.) ছিলেন একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিকও। তাঁর বহু গ্রন্থ আছে যা তাসাউফ, ইস্লাহে নফস এবং আল্লাহর প্রেমের মধুরতায় ভরপুর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো:
মা'আরিফুল কুরআন – কুরআন মাজিদের তাফসিরমালা
মা'আরিফুল হাদিস – হাদিসের ব্যাখ্যা
দিল কি দুনিয়া – অন্তরের জগত সম্পর্কে গভীর আলোচনা
সুলুকে আশিকান – আল্লাহর প্রেমের পথে সুলুক
মুজাহিদে নফস – নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ
তাঁর বইগুলোতে ভাষার সরলতা, হৃদয়স্পর্শী উপদেশ এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্যতা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও দাওয়াহ
মাওলানা সাহেব (রহ.)-এর দাওয়াহর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি মানুষকে একদিকে আমল ও সুন্নাহর গুরুত্ব বুঝাতেন, অন্যদিকে চরমপন্থা বা কঠোরতা থেকে বাঁচতে উপদেশ দিতেন। তাঁর বয়ানগুলোতে আল্লাহর প্রেম, নবীর সুন্নাহর অনুসরণ, পাপ থেকে মুক্তির পথ এবং অন্তরের পবিত্রতার ওপর বেশি জোর দেওয়া হতো।
তিনি বলতেন – “তাসাউফ মানে নতুন কিছু উদ্ভাবন নয়, বরং নবী করীম (সা.)-এর সুন্নাহর পূর্ণ অনুসরণ।”
সমাজে অবদান
মাওলানা হাকীম মুহাম্মদ আখতার (রহ.) সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। শিক্ষিত তরুণ, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, এমনকি সাধারণ কৃষক-শ্রমিক – সবার জন্য তিনি সহজ ভাষায় উপদেশ দিতেন। তিনি তরুণ প্রজন্মকে চরিত্রবান হতে উদ্বুদ্ধ করতেন, নেশা ও অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকতে বলতেন।
তিনি অসংখ্য মানুষকে গুনাহের জীবন থেকে তওবার পথে ফিরিয়ে এনেছেন। তাঁর খানকার মাধ্যমে হাজার হাজার মুরিদ আধ্যাত্মিক উন্নতি অর্জন করেছে এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করে যাচ্ছে।
ওফাত
মাওলানা হাকীম মুহাম্মদ আখতার (রহ.) ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তাঁর জানাযায় লক্ষাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করে। আজও তাঁর খানকা-এ-আখতরিয়া পরিচালিত হচ্ছে এবং তাঁর খলিফাগণ বিশ্বজুড়ে দাওয়াহ ও ইস্লাহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
উত্তরাধিকার
মাওলানা হাকীম মুহাম্মদ আখতার (রহ.)-এর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার শুধু তাঁর বইপত্র নয়, বরং এমন এক আধ্যাত্মিক ধারার প্রতিষ্ঠা যা লক্ষ লক্ষ মানুষের অন্তরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। তাঁর জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি – আল্লাহর প্রেম অর্জনের জন্য নামাজ, জিকির, তওবা এবং সুন্নাহ অনুসরণের বিকল্প নেই।